আমার জীবনের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত
ছেলেবেলায় বাবা-মা আর চার ভাইবোন নিয়ে আমাদের যে সংসারটি ছিল সেটি ছিল প্রায় রূপকথার একটি সংসার। একাত্তরে বাবাকে পাকিস্তানী মিলিটারিরা মেরে ফেলার পর প্রথমবার আমি আর আমার মা সত্যিকারের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিলাম। সেই দুঃসময়ে আমার মা কিভাবে বুক আগলে আমাদের রক্ষা করেছিলেন সেটি এখনও আমার কাছে রহস্যের মতো। পুরো সময়টা আমরা রীতিমতো যুদ্ধ করে টিকে রইলাম। কেউ যদি সেই কাহিনীটুকু লিখে রাখতো সেটা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের মতো হতো । আমাদের জন্ম হয়েছিল মধ্যবিত্ত ব্যাবসায়ি বাবার সুখের ঘরে জন্মের পর এগার বৎসর জীবনে কখনো অভাব দেখিনি কিন্তু যখন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তীযুদ্ধের সময় আমাদের নোয়খালী জেলার প্রনকেন্দ্র চৌমুহানির বাদামতলা রোডের “মেসার্স-ভুলুষ্টোর” নামিয় বৃহত্তম ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানটি লুট-পাট হয়ে যায় এবং এর কিছু দিন পর বিশেষ কাজে বাবা চাঁদপুর যাওয়ার পথে পাকহানাদাররা আমার বাবা কে রেলগাড়ী থেকে নামিয়ে নিয়া চিতোষী রেল ষ্টেশানের পূর্ব র্দিকে কালবার্ট রেলব্রিজের উপর চোখবেঁধে আরো তিনজন সহ একসাথে গুলি করে হত্যা করে এবং চারজনকে একই সাথে কবরের মতকরে তাড়াহুড়া করে পাকহানাদারেরা অন-ইসলামিক পদ্দতিতেই মাটি চাপা দেয়, দাপন-কাফন এবং জানাজার নামাজ পেল না আমার বাবা ও সাথের তিন জন, নিরিহ নাগরিক অথচ গণকবরেই সমাহিত হলো , এর পর আস্তে-আস্তে আমি অভাব বুঝতে শুরুকরি। এরকিছু দিন পর দেশটা স্বাধীন হলো কিন্তু আমাদের সব শেষ হয়ে গেল,বাবা ও নেই,অর্থ-সম্পদ তেমন কিছু্ নেই। আমার মায়ের অস্তিত্ব থেকে ব্যাবসায়ি মুক্তিসংগ্রামী, স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখা পিতার বুকে তৎকালিন রাষ্ট্রীয় হানাদার পাক বাহিনীর গুলিবর্ষণের আওয়াজ শোনা বালকটি জীবনেরবহু বৎসর পার করে আজ মধ্য বয়সে পা রাখলাম। কিন্তু কি দেখছি..? আমার পিতার সম্পদ ও রক্তে কেনা, স্বপ্নেদেখা স্বাধীন বাংলার এই কেমন হাহাকার, এই জন্যই কি একসাগর রক্ত, এত মায়েরা ইজ্জত হারিয়ে ছিলো ? এই কি স্বাধীনতা..? নিশ্চই না... না…।
একটি প্রশিক্ষিত ৯৮হাজার চৌকষ পাক-সেনাবাহিনীর এবং তাঁদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে যারা রুখে দাঁড়িয়ে ছিলো প্রবল ইচ্ছা শক্তিকে পুঁজি করে সাহস ও সম্ভ্রম আর রক্তদিয়ে, তাঁদের স্বপ্ন আজো অধরায় রয়ে গেছে। সেই স্বপ্ন পূরণে সামাজিক ন্যায্যতা, রাষ্ট্রীয় সেবা-সম্পদে সমান অধিকার ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে এখন ক্ষমতার দুবৃত্তায়ন, ঊপনিবেশিক আমলাতন্ত্র, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রভু সুলভ আচরণ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুন্ঠনকরে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েতোলা আর সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী লালন পালন করে সেই সম্পদরক্ষা করা, আবার জরিমানা দিয়ে টাকা সাদা করে সমাজপতি হওয়ার প্রবণতা, ধর্ম ও রাজনীতি এক নয় তবু ও ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে এনে বর্ণ চোরা সুবিধা ভোগিরা দলের পরিচয়ে লুটপাটে দিশেহারা । কেন-এরা কারা ? রাষ্টীয় নিরাপত্তায় বিনিয়োগে উৎসাহিত করে, সেই বিনিয়োগের টাকা কারসাজির মাধ্যমে লুটে-পুটে নিয়ে যাওয়া, বিনিয়োগ কারিদের কে সর্ব্বহারা করে দেওয়া, এই সকল জগন্য অন্যায়ের প্রতিবাদে স্বোচ্ছার হয়ে পিতার চাওয়াকে ধারণ করে আগামী সময়ের দৃঢ়প্রত্যয়ে পরিবর্তনের আস্হা বিশ্বাসে এগিয়ে যেতে চাই । আমার একটা বিশ্বাস ছিলো অনুযদের উপর একটা আশা ও ছিলো কিন্তু সেটা ও যে আমার চরম ভুল হয়েছে তা বুঝতে অনেক সময় গড়িয়ে গেছে । দুনিয়াতে এমন কোন বিশ্বাস নেই যেটা ভেঙ্গে পড়েনা, কেবল মাত্র বিশ্বস্ত কুকুরের বিশ্বাস ছাড়া, এটাই এখন শান্তনা । পিতার ছেলেরা ও যে স্বার্থের জন্য মিথ্যা বলতে পারবে সেটা আমার অজানা ছিলো , তবু ও আমি মনে করি সহযাত্রি না থাকলে একলা হলে ও আজ আর কোন আপত্তি নেই, এ ও আমি জানি এই পথে আমি একা নই বহু পথিক। এই পথ চলায় দেখা যাক কতটুকু ছলতে পারি । জীবনতো এখন মাঝপ্রান্তে,আমার জীবনের বড় অংশজুড়ে বাংলাদেশএর প্রত্যন্ত অঞ্চল, গ্রাম বাংলায় জুয়েলারী মালিক-শ্রমিকদের আইনগত অধিকার, তারই সাথে নারী অধিকার ও অধিকার বঞ্চিতদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার এবং সামাজিক সম্মান ও অসমপ্রদায়ীক সমাজ নিশ্চিত করার জন্য সারা বাংলায় আমি ঘুরে বেড়িয়েছি । কখোনো এককভাবে , কখোনোবা যৌথ/দলবদ্ধভাবে।
মানুষের ন্যায্যতা প্রাপ্তি নিশ্চিত করাই আমার জীবনের ব্রত হিসাবে জেনেছি, মেনেছি এবং সে ভাবেই কাজ করার চেষ্টা করেছি । যে বা যারা আমার এইসকল কাজের প্রেরণা বা সহযোগি তাদের সকলের কাছেই আমি কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে খাদেমভাই, ছায়েদভাই, কালাম মজুমদার, শাজাহানভাই, কাজি হারুন, আনিছ ভাই, জাহের চৌধুরী ও সৌয়দ শামসুল আলম হাসু ভাইর কথা মনে পড়ে। আরো মনে পড়ে প্রিয় আনোয়ার ভাই, স্বপন, সেলিম, গুলজার ভাই, সত্যদা, মন্টুভাই, ওয়াদুদখাঁন, কজীসিরাজ, হান্নানআজাদ, দিলিপদা, নান্টুদা, সুখেন্দু , বাবা আনোয়ার, বাবলু ভাই , হারুন-বাকের-হোসেনসাব-বাবুল–খোকন-বাহার, নারু - নারায়ন পাল (দাদা) ও বাবু গঙ্গা চরন মালাকার সহ স্মৃতিচারণায় অনেক বন্ধু ও স্বজ্জনকে । এদেরকে আমি কখনো ভুলতে পারব না, পারি না । বিশেষত সেলফহেলপ মানসিকতা তৈরী করে সারা বাংলায় যেসব সিঙ্গেলমাদার দেরকে আমি পথ চলতে শত অপবাদের মুখে ও আলো ধরেছি তাদের যেকোন সাফল্য এখন আমাকে উদ্বেলিত করে। যখন সরকার পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ, নিরোধ ও সুরক্ষা আইন পাশ করে , এসিড সন্ত্রাস ও যৌতুকের বিরুদ্দে কথা বলে, নারী নির্যাতনে সমাজ প্রতিবাদ করে তখন আমার চোখ ভিজে আসে এটাইতো স্বাভাবিক। আজ আমি মাঝ বয়সী মানুষ কিন্তু মনেপ্রাণে আজো আমি ২৫ বছরেই থেমে আছি । কারন আমি জানি আমাকে বেঁচে থাকলে আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে । আরো অনেক অনেক কাজ করতে হবে এবং করতে চাই। আমার জন্মের ঋণশোধ করতে হবে কিন্তু মৃত্যূদিয়ে নয় ।
সকল তিমির কেটে যেদিন প্রতিটি শিশু সুশিক্ষা অর্জন করবে, যেদিন প্রতিটি নারী মাতৃত্বের পুর্বে সু-চিকিৎসা পাবে ও তার শ্রমের,ঘামের সঠিক মূল্যপাবে, যেদিন আর কোন নারীর শরীর এসিডে পুড়ে ঝলসে যাবেনা। সকল র্ধমাবলম্বীদরে জীবন, সম্পত্তি র্ধম এবং ধর্মীয় উপাসনালয় নিরাপদ করা হবে, প্রতিটি শ্রমিক তার শরীরের ঘাম শুকাবার আগেই তার ন্যায্য মজুরী বুঝে পাবে, জুয়েলারী মালিক শ্রমিক পাবে তাদের আইনগত অধিকার, আর অহেতুক হয়রানি হবে না, দূরবিত্ত না হলে বিনাবিচারে জীবন দেবেনা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। সমপ্রদায়ীক দাঙ্গা বাঁধবে না, কোন মা, কোন বোন আর সমভ্রম হারাবে না সমাজে। সেদিন আমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবো হাসতে - হাসতে । যে পৃথিবী আমি পেয়েছি তার চেয়ে সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে চাই, তবেই শোধ হবে আমার জীবনের ঋণ সার্থক হবে জীবন এটা আমার বিশ্বাস । জীবন চলার পথে আমার সকল বন্ধু গণের প্রতি ও তাঁহারা যে জাতির অন্তর্গত থাকুক তাঁহাদের সকলের প্রতি আমি চিরদিন কৃতজ্ঞ ।
আমি আশা করি, এই বৃত্তান্তটি সংক্ষিপ্ত বলিয়া আমার অনেক প্রীয়বন্ধু ও স্বজ্জন কে স্বরণ করতে পারি নাই মার্জনা করিবেন; কেননা এখানে বিশেষ বিবরণ সকল লিখিবার আমার সুযোগ নাই । যারা অতীতকে ভুলে যাবে , ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদেরকে ধিক্কার জানাবে “ইতিহাস কে আড়াল করে রাখা যায় কিন্তু বিলীন করা যায় না” । তাই সকলের প্রতি অনুরোধ ইতিহাসকে-অতীতকে স্বরন করে সামনের পথ চলুন “মুনাফেকের নিকট থেকে শিক্ষাগ্রহন করুন আর বন্ধুসজ্জন কে মনে রাখুন” আমার এই লিখায় কারো সুকোমল অনুভুতিতে সামান্য দুঃখ পেলেও নিজ গুনে মার্জ্জনা করবেন। …… “আলহামদুলিল্লাহ”…… পরিশেষে মনেপড়ে আমার পরম স্নেহময়ী মাকে । মা-পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শব্দ। যে মানুষটি তার সন্তান নিয়ে সবচেয়ে বেশি স্বপ্ন দেখেন তিনিই মা, আর অন্যকেউ না । আমার একটু সুখের জন্য ,একটু ভালখাওয়ার জন্য, নিরাপদ ও নিরাপত্তার জন্য মা আমার সাথে মিথ্যা বলতো । আমার মা ছিলো নিঠুর মিথ্যাবাদী, বাবা মরারক’দিন পরেই মারা গেল নিঠুর মিথ্যাবাদী । সেই মিথ্যাবাদী মায়ের জন্য আজো আমি কাঁদি । সকল মায়ের জন্য বিনম্র শ্রদ্ধা । সবার জন্য শুভ কামনা ।
১৯৭১ এর মহান মুক্তীযুদ্ধে অংশ গ্রহন কারি সকলকে জানাই সালাম /শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন । স্বরণ করি ১৯৭১ এর মুক্তীযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গ-বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং তৎকালিন সকল জাতীয় নেতাদেরকে এবং ৭১ এর মহান মুক্তীযুদ্ধের সর্বস্তরের সকল শহীদেরবিদেহি-আত্নার মাগফেরাত কামনা করছি ।
পরিশেষে পরম করুনাময় আল্লাহ্ আমাদের সহায় ও সাহায্য দাতা হউক।সকলকে ধন্যবাদ।